পশ্চিমে বইখরা



আবুল হাসান আলী নাদউই গুরুত্বপূর্ণ একটা পয়েন্ট ধরেছেন।[1] যে সময় মুসলিম বিশ্বে কোলোনাইজেশন, শুরু হয়েছিল, ঠিক সেই সময় ‘আলিমদের উচিত ছিল ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান আর ডাচ (উনার মতে এই চারটা) ভাষায় ইসলামের প্রত্যেক ফিল্ডের (একটা ‘ইত্যাদি’র সাথে দশটার নাম নিয়েছেন) বই লিখে উড়িয়ে ফেলা। সেরকম হলে তারা মুসলিমদের বোঝার জন্য যখন ইসলাম স্টাডি শুরু করতো, তখন মুসলিমদের লেখা বইয়ের উপর ভিত্তি করেই এগিয়ে যেত। নিজেদের থেকে গবেষণা করে সমস্যা সৃষ্টি করতো না। একটা ওরিয়েন্টালিস্টিক পরিবেশ সৃষ্টি হত না। কিন্তু আলেমসমাজ কি করেছেন? “এসব কাফিরদের ভাষায় আমরা লিখি না”!

এমন গোঁড়ামি ইসলামের ইতিহাসে আগেও দেখা গিয়েছে। মুসলিমদের কাছে প্রিন্টিং প্রযুক্তি ছিল, কিন্তু মুসলিমরা কোনসময় সেটা ব্যবহারই করেনি[2], “আরবি পবিত্র ভাষা, এই ভাষার বই সমূহ প্রিন্ট করা যাবে না” পরে ইউরোপিয়ানরা এসে মুসলিমদের থেকে শিখে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে বহুদুর। আর এখন, ‘আলিমরা না লেখায় ওরিয়েন্টালিস্টরা গবেষণা করে নিজেরা কাজ করেছেন, ইসলামের উপর পুরো এক ওরিয়েন্টালিস্টিক অ্যাকেডিমিয়া গড়ে উঠেছে আর নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়েছে কোটি কোটি মানুষ। চিন্তা করতে পারেন এই বোকামির কারণে কত বড় ক্ষতি হয়েছে? সারা বিশ্ব এই ওরিয়েন্টালিস্টিক কালচারের কারণে ইসলামের ব্যাপারে অসংখ্য জায়গায় বিভ্রান্ত হয়েছে।

আবুল হাসান আলী নাদউই ১৯৮১ সালে[3] আক্ষেপ করেছেন যে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান অর্জন করতে হলে নন-মুসলিমদের লেখা বই পড়তে হয়। আর এখন দেখেন, উনি বলার ৪০ বছর পেড়িয়ে গিয়েছে, এখনও কেবল ইংরেজি ভাষাতেই মুসলিমদের লেখা বইয়ের অভাব, অন্যান্য ভাষা তো দূরে থাক। যদি উদাহরণ হিসেবে ইতিহাস ধরি, Philip K. Hitti এর History of the Arabs এর সমমানের মুসলিমদের লেখা একটা বইও নাই ইংরেজি ভাষায়![4] অবস্থা টা দেখেন, নন-মুসলিমরা উনার বই রিপ্লেস করার জন্য আরও হাই কোয়ালিটি কাজ করেছেন; ইরা ল্যাপিডাস History of Islamic Societies লিখেছেন, অ্যালবার্ট হুরানী History of Arab Peoples লিখেছেন, কিন্তু মুসলিমরা নিজেদের ইতিহাস নিয়ে আজ পর্যন্ত এমন লেভেলের একটা বইও ইংলিশে লেখেনি। শাহ আকবর খান নাজিবাবাদীর বই ইংলিশে আছে, কিন্তু ঐটা কি একজন ওয়েস্টার্ন পাঠক পড়বে? লেখার ধরণ আর সাহিত্যে কি সেটা উপরোক্ত বইগুলোর সমকক্ষ? না। ইরা ল্যাপিডাসের বই হাজার পৃষ্ঠা, তবু জেনারাল রিডাররা বইটা পড়ে, এমন ভাবে লিখা। সেরকম বই লাগবে, অবশ্যই। আবুল হাসান আলী নাদউইও কথাটা বলেছেন, আরও বোল্ডলি। একটা সাবজেক্টে মুসলিমদের সিরিয়াস আগ্রহ দেখা যায়ঃ নাস্তিকতা। এই বিষয়েও, ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা ভালো মানের সামগ্রিক বই মাত্র ৩ টা![5][6]


শেষকথাঃ এর মানে অবশ্যই এটা না, যে ওয়েস্টার্ন স্কলারদের থেকে আমরা নিতে পারব না। আবুল হাসান আলী নাদউই নিজেই কিছু পশ্চিমা স্কলারের ভূয়সী প্রশংসা করেন আর বলেন যে তাদের থেকে নির্দ্বিধায় তথ্য নেওয়া যাবে। কিছু কিছু ওয়েস্টার্ন স্কলারের ব্যাপারে তিনি বলেন যে, মুসলিমরাও কখনও এমন অসাধারণ কাজ করতে পারেনি যা তারা করেছেন, এমনকি কিছু বই ইংরেজি বা অন্য ভাষায় তারা লেখেছেন, তা আরবি তে অনুবাদ করে আরবের ইসলামী স্কলাররা ব্যবহার করেন! এখানে শুধু আক্ষেপ হচ্ছে মুসলিমদের নিজেদের লেখা বইয়ের অভাব। ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।


এখনকার ওয়েস্টার্ন স্কলারদের থেকে আরও ভালোমানের ও অধিক অথেনটিক বই পাওয়া যায়, আর এর ওরিয়েন্টালিস্ট না, বরং ইসলামিক স্কলারই। অধিক পঠনের ফলে তারা এখন আগের ওরিয়েন্টালিস্টদের মত অসৎ না। তাছাড়া ওয়েস্ট এর বড় বড় ইউনিভার্সিটিগুলোতে এক জ্ঞানের পরিবেশ আছে, যা দুঃখজনকভাবে অনেক মুসলিম দেশে নাই। আবুল হাসান আলী নাদউই কিছু স্কলারের ক্ষেত্রে বলেছেন যে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে তাদের থেকে নেওয়া যাবে, বর্তমানে হলেও অনেকের ব্যাপারে এমনই বলতেন। Bloomsbury, Oneworld, Kube আর অ্যাকেডেমিক প্রেস যেমন Brill, Routledge সাথে দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস থেকে প্রকাশিত বইগুলো সে মনোভাব নিয়েই পড়তে পারেন, যে মনোভাব নিয়ে মুসলিমদের লেখা বই পড়েন।

অবাক হবেন, কিছু ক্ষেত্রে নন-মুসলিম স্কলাররা মুসলিম স্কলারদের থেকে বেশি ইসলামের স্বপক্ষে! অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, একটা দিচ্ছি। হেনরি লাউস্ট, জন হুভার[7] ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহর উপর বড় দুই স্কলার। উনারা ইবন তাইমিয়্যাহর অনেক প্রশংসা করেন, ডিফেন্ড করেন। অন্যদিকে মাজিদ ফাখরি[8], হুসেইন জিয়াই[9] মুসিলম হওয়ার পরও ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহকে আক্রমণ করে কথাবার্তা লিখেছেন।


Notes:
[1] সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী, মুসলিম লেখক ও প্রাচ্যবিদদের ইসলাম বিষয়ক গবেষণামূলক মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা (ঢাকাঃ মুহম্মদ ব্রাদার্স, ২০১৫)
[2] Geoffrey Roper. “Muslim Printing Before Gutenberg” muslimheritage.com.
[3] ১৮৭৫ থেকে ১৯৮১ সালের মাঝে ইংরেজি ভাষায় মুসলিমদের লেখা ভালোমানের কিছু বইয়ের একটা লিস্ট দেন আবুল হাসান আলী নাদউই। জেনে নিতে পারেন এখান থেকেঃ https://armanfirman.blogspot.com/2020/04/book-recommendation.html
[4] এর মানে এটা না যে পি কে হিট্টির বই ভালো না। এটা সেরা একটা বই, আবুল হাসান আলী নাদউইও এর ব্যাপারে নেতিবাচক কিছু বলেননি। আমি যে কাউকে এই বইটি পড়তে রেকোমেন্ড করব।
[5] Shoaib Ahmed Malik, Atheism and Islam: A Contemporary Discourse (Kalam Research and Media, 2018) p. 32
[6] ড. ফজলুর রহমানও ২০ শতকে অরিয়েন্টালিস্টদের দ্বারা লেখা কিছু ইসলামিক বইয়ের ব্যাপারে মতামত দিয়েছেন, উনারটা অবশ্য একটু ডিপঃ Fazlur Rahman, “Some Recent Books on the Qur'ān by Western Authors” The Journal of Religion, Vol. 64, No. 1 (1984), pp. 73-95. Available at: http://www.jstor.org/stable/1203149
[7] Jon Hoover. “Perpetual Creativity in the Perfection of God: Ibn Taymiyya’s Hadith Commentary on God’s Creation of This World” Journal of Islamic Studies 15:3 (2004) pp. 287–329.
[8] Tim Winter (edt), The Cambridge Companion to Classical Islamic Theology (Cambridge University Press, 2008) p. 76
[9] Majid Fakhry, A History of Islamic Philosophy (Columbia University Press, 2004)

Post a Comment

0 Comments