সমালোচনাঃ নবম-দশম শ্রেণীর ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি বইয়ে বিজ্ঞানের ইতিহাস



২০১৭ ও ২০১৮ সালের বইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। (১৭) ও (১৮) বলতে যথাক্রমে বই দুটিকে আলাদা করা হয়েছে।
-----------------------------------------

বিজ্ঞানের ইতিহাস একটি আলাদা সাবজেক্ট। একজন ফিজিক্সে পিএচডি করে ফেললেও ফিজিক্সের ইতিহাস লেখতে গেলে তার জন্য আলাদা পড়ালেখা করতে হবে। তা হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে, অথবা নিজে নিজে – কোন সমস্যা নেই। স্টিভেন ওয়াইনবার্গ ফিজিক্সে নোবেল পেয়েছেন, কিন্তু মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞানের পতনের ব্যপারে যেসব বলেছেন, তার কোন ভিত্তিই নেই।

যাহোক, তাহলে শুরু করছি ফিজিক্স দিয়ে। ফিজিক্স (১৭) তে যা লেখা হয়েছে, তা পড়ে মনে হয় না লেখক গণ তেমন ঘাটাঘাটি করেছেন। শুধু নিজ পড়ালেখা করার সময় যা সামনে এসেছে তাই উল্লেখ করে দিয়েছেন। (১৮) পড়লে অবশ্য মনে হয় যে কিছু হোমওয়ার্ক করা হয়েছে। (১৭) তে শুরুতেই জঘন্য এক ভুলের কথা উল্লেখ করছি –
১। ইবন আল-হাইসাম এবং আল-হ্যাজেন (Alhazen)  কে আলাদা দুজন মানুষ দেখানো হয়েছে! উল্লেখ্য, অ্যালহ্যাযেন, ইবন আল-হাইসাম এর ল্যাটিন নাম। লেখকদের বিজ্ঞানের ইতিহাস সম্বন্ধে জ্ঞান কেমন সমুন্নত তা দেখতেই পারছেন। (১৮) এই ভুল না করলেও, বানান ভুল করে রেখেছে। হাইসাম কে লেখছে হাইয়াম। মানে, একটা না একটা ভুল করবেই!

২। ফিজিক্স (১৭) তে লেখা হয়েছে যে রজার বেকন পরীক্ষামূলক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবক্তাঅথচ বর্তমানে এটি প্রতিষ্ঠিত যে পরীক্ষামূলক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবক্তা ইবন আল-হাইসাম[১]। পশ্চিমের নন-মুসলিম দেশগুলোতে মুসলিমদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হয়; কিন্তু বাংলাদেশের মতো মুসলিম অধ্যুষিত দেশে হয় না। পারলে লুকায় আরও।
৩। থেলিস লোডস্টোনের চুম্বক তত্ত্ব সম্বন্ধে জানতেন।
একজন বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত প্রতিভা উল্লেখ করা ভাল, যখন তার ব্যপারে সম্পূর্ণ আর্টিকেল লেখা হচ্ছে তখন। কিন্তু যখন আড়াই পৃষ্ঠার মধ্যে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানের ইতিহাস আটানো হচ্ছে, তখন এসব উল্লেখ করার মানে কি? বিজ্ঞানের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রতিভার তেমন গুরুত্ব নেই, যদি না তার কোনরূপ প্রভাব থাকে। এখন তিনি ‘জানতেন’ কিন্তু এ দিয়ে কিছু করেননি, তো তার জানার তেমন দাম নেই।[২] একই ভুল (১৮) তেও করা হয়েছে। 

৪। লেখা হচ্ছে ‘আরবরা’ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন।
আরবরা মানে কি? ইবন সিনা ফারসি ছিলেন, মুহাম্মাদ আল-খাওয়ারিযমী ও আল-বিরুণী ছিলেন খাওয়ারিযমী; যা বর্তমানে উযবেকিস্তানে (খিভা আধুনিক নাম)ইয়াকুত আল-হামাউই গ্রীক; আল-যারকালী, জাবির ইবন-আফলাহ, ইবন তুফাইল, ইবন রুশদ স্প্যানিশ। বদিউজ্জামান আল-জাযারী টার্ক – তা আরব বিজ্ঞানী বলতে কি বোঝাচ্ছেন লেখকগণ?? সর্বাধিক গৃহীত মতঃ Muslim scientistআধুনিক কিছু ইতিহাসবিদের মতেঃ Arabic scientistকিন্তু সামগ্রিক ভাবে আরব বিজ্ঞানী বলা বরাবরই ভুল। 

৫। আল-মাসুদী এর বিশ্বকোষে বায়ুকলের উল্লেখ পাওয়া যায়।
যা উৎকৃষ্ট তা লেখবে না, যা লেখে কাজ নাই তা ঠিকই লেখে দিবে। বায়ুকল কোন নতুন কিছু না। আগের জাতিগুলোতেও এর ব্যবহারের চিহ্ন রয়েছে। মুসলিম বিশ্বে উমর (রা) এর সময় হতেই তা দৃষ্ট।[২]

৬। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি কিছু যন্ত্র দক্ষতার সাথে উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন – এটা লেখে দিবে, কিন্তু তাক্বী আল-দ্বীন রাশিদ যে একাধিক অ্যাস্ট্রোনমিকাল যন্ত্র পারফেকশন এর সাথে উদ্ভাবন করেন, তা লেখবে না।[৪] 

৭। (১৮), (১৭) এর তুলনায় ভালো। কিন্তু শুরুতেই সামগ্রিক বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখা হয়েছে – বিজ্ঞানীদের পুড়িয়ে মারার উদাহরণও দেখা যায়। সামগ্রিক ভাবে এটা বলা উচিত হয়নি কারণ মুসলিম বিশ্বে, সম্পূর্ণ ৮০০ বছরের স্বর্ণযুগের ইতিহাসে ইসলামের কোন নেগেটিভ প্রভাব তো দুরে থাক, বরং ইসলাম ছিল বিজ্ঞানের ড্রাইভিং ফোর্স[৫]। 
আরও লেখা হয়েছে প্রচলিত বিজ্ঞান বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বলা রিস্কি ছিলঅথচ মুসলিম বিশ্বে এর অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপঃ শুকুক আলা জালিনুস (গ্যালেনের উপর সন্দেহ) – আবু বকর আর-রাযী; শুকুক আলা বাতলামিউস (টলেমির উপর সন্দেহ) – ইবন আল-হাইসাম। টলেমি আর গ্যালেনের কথাকে ঐ সময়ে ধ্রুব সত্য বলে ধরা হলেও মুসলিম বিজ্ঞানীরা তাদের বিরুদ্ধে লেখতে পিছপা হননি। 

৮। ‘আরেকজন বিজ্ঞানী হলেন...’ এই স্টাইলে লেখা হচ্ছে (১৮)। এভাবে লেখলে বিজ্ঞানীদের সংখ্যা অনেক কম ছিল মনে হয়, বাস্তবতা সেরকম না। 

৯। পশ্চিমের প্রতি আসক্তি ফুটে উঠে ২০১৮ এর ফিজিক্স বইয়ে। গ্রীক বিজ্ঞান উল্লেখ করার পর তারা বলেন, “এরপর প্রায় দেড় হাজার বছর জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা প্রায় বন্ধ ছিল। শুধু ভারতীয়, মুসলিম এবং চীনা ধারার সভ্যতা গ্রীক ধারার এই জ্ঞানচর্চা কে বাচিয়ে রেখেছিল”
গ্রীকরা মনে হয় কারো থেকে নেয় নি আর ইন্ডিয়ান, মুসলিম, চাইনিজরা যেন তাদের বিজ্ঞানই রক্ষা করে আবার পশ্চিমের হাতে তুলে দিয়েছে জাস্ট, আর কিচ্ছু না। মনে হচ্ছে কোন পশ্চিমাবাদীর লেখা পড়ছি, বাংলাদেশী রাইটারদের লেখা বই পড়ছি না! লেখকদের তালিকা দেখি তো একবার......আচ্ছা, এখানে তো জাফর ইকবাল রয়েছেন! 

বিজ্ঞান কোন সময় আকাশ থেকে পরে না। একজন আরেকজন থেকে নিয়েই বিজ্ঞান এগিয়ে যায়। গ্রিকদের জ্ঞানের সূত্র হল প্রাচীন ইজিপ্ট, মেসোপটেমিয়া, পারস্য ইত্যাদি।[৬] কারো যদি মনে হয় ‘এত আগেও বিজ্ঞান ছিল নাকি!’ A.C. Graham এর মতে, মায়া ও চাইনিজ সভ্যতার বিজ্ঞান, কোপার্নিকাস আর কেপলার এর বিজ্ঞান হতে আধুনিক বিজ্ঞানের অধিক কাছে ছিল![৭] 

যাহোক, লেখকগণ এখানে নন-ইউরোপিয়ান বিজ্ঞান এর দিকে একদম নিচু চোখে তাকিয়েছেন। এমন ভাব যেন তারা কিছুই করে নি। আসলে, এমন বিশ্বাসই সারা পৃথিবীর ‘শিক্ষিত’ সমাজে দেখতে পাওয়া যায়। আর এই ভুল বিশ্বাস এর অপনোদন করাই শিক্ষিত মানুষদের দায়িত্ব।[৮]
কোপার্নিকাস খৃষ্টানদের ভয়ে ছিলেন সত্য, এজন্য তার বই মৃত্যুর ঠিক আগে আগে প্রকাশ করেন। কিন্তু ফিজিক্স (১৮) তে খৃষ্টান চরমপন্থি উল্লেখ না করে লেখা হয়েছে ‘ধর্মযাজক’। খৃষ্টানদের কারণে একদম সকল ধর্মের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন লেখকগণ।

একটি জিনিস উল্লেখ করা যায়। ফিজিক্স (১৮) তে যতধরনের পরিবর্তন এসেছে, সব এনেছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং মোহাম্মদ কায়কোবাদ। (১৭) তে সরাসরি ভুল দেখা যাচ্ছে, (১৮) তে তেমন না থাকলেও বারংবার ধূর্ততা দেখতে পাচ্ছেন। সরাসরি ভুল না করলেও, যেসব স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছে, তা পূর্বের চেয়েও সাংঘাতিক।

কেমিস্ট্রি (১৭) তে ইতিহাস নেই। কেমিস্ট্রি (১৮) এর ব্যপারেও লেখার কিছু নেই, শুধু এতটুকু লেখা যায় অ্যালকেমি থেকে কেমিস্ট্রির রুপান্তর ইসলামী স্বর্ণযুগেই হয়েছিল, ইউরোপিয়ানদের হাতে নয়।[৯] 

রেফারেন্সঃ 

1.      দেখুন, Bradley Steffens, Ibn al-Haytham: The First Scientist; মুসলিম বিজ্ঞানীদের নিয়ে বানানো জিম আল-খালিলীর ডক্যুমেন্টারি দেখুন:
2.      কোন ভাবেই, কোন ক্রমেই এখানে থেলিস কে আক্রমণ করা হচ্ছে না। তিনি একজন উচুমাপের বিজ্ঞানী ছিলেন। এখানে শুধুই লেখকদের বিজ্ঞানের ইতিহাস লেখার ধরণকে আক্রমণ করা হচ্ছে
3.      Roshdi Rashed (edt), Encyclopedia of the history of Arabic Science, vol. 3 মেকানিক্স অংশ দ্রষ্টব্য।
4.      Ottoman Contribution to Science and Technology – Salim Ayduz (muslimheritage.com)
5.      পড়ুনঃ মধ্যযুগের বিজ্ঞানীদের সাফল্যে ইসলামের কোন অবদান আছে কি?:
6.      Origins of Islamic Science – Dr. Muhammad Abdul Jabbar Beg (muslimheritage.com)
7.      Continuity Thesis – Wikipedia.org
8.      কয়েকটি লেখার জন্য দেখুনঃ
9.      The Advent of Scientific Chemistry – Salim al-Hassani and Mohammed Abattouy (muslimheritage.com); From alchemy to chemistrySalim al-Hassani (muslimheritage.com); জিম আল-খালিলীর লেকচার দেখুনঃ


Post a Comment

0 Comments