জাগ্রতের জীবিত সন্তান




হন্তদন্ত হয়ে ক্লাস রুমে ঢুকলাম।

“কিরে, তুই কালকে আসিস নি কেন? মারতে পারলাম না তোকে!” তারিকের মশকরা।

তবে তার কথায় কান না দিয়ে আমি সিনানকে গিয়ে ধরলাম, “সিনান! গতকাল কী হয়েছে জানিস?”

“তুই না বললে ও কীভাবে জানবে?” হেসে বলল তারিক।

“গতকাল আমি আমাদের ঘরের পুরনো বুকশেলফটা পরিষ্কার করছিলাম। আর তখনই একটা বই আমার হাতে আসে। আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় বইটা অনেক পড়েছি, আমার জীবনে পড়া সেরা এক বই এটা। বইটার নাম ‘আজব শিশু’। কোনো সময় বইটার লেখকের নাম দেখিনাই, কিন্তু কালকে খেয়াল করলাম, ইবনে তোফায়েল আন্দালুসি। ইবনে তোফায়েল ঠিকাছে, কিন্তু আন্দালুসি? আন্দালুস মানে মুসলিম স্পেইন! উনি নিশ্চয়ই বড় কিছু হবেন, সিনান।”

“হুম, বইটা পড়েছি। মূল বই এর নাম Hayy ibn Yaqzan। ইংরেজি করলে অর্থ দাঁড়ায় Alive Son of Awaken। ল্যাটিন নাম Philosophus Autodidactus। তুই যেটা পড়েছিস সেটা তো বাচ্চা ভার্সন।”

তারিক হেসে উঠল, “সেই বই পড়িস তুই আরমান, বাচ্চা ভার্সন তোর জীবনে পড়া সেরা বইগুলোর মধ্যে একটি হয়ে গেছে, হে হে!”

“আবু বকর ইবন তুফাইল একজন ফিজিশিয়ান ছিলেন, মুসলিম স্পেইনে। ইবন রুশদের টিচার, তিনি একজন স্বনামধন্য ফিলোসফারও বটে। তার বইটা পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম ফিলোসফিকাল উপন্যাস। আজ পর্যন্ত বইটির দার্শনিক গুরুত্ব রয়েছে।[১২] ১৭-১৮ শতাব্দীতে সারা ইয়োরোপে খুব প্রভাবশালী একটা বেস্টসেলারে পরিণত হয় সেটা।[১] আধুনিক ওয়েস্টার্ন ফিলোসফির উপরও এইটার বিরাট প্রভাব আছে।[২] ইউরোপিয়ান এনলাইটেনমেন্ট আর সায়েন্টিফিক রেভোল্যুশানের ব্যাপারে তো জানিস? এগুলোর পিছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর একটা হলো এই বই। নিউটন, ক্যান্ট, জন লক, থমাস হোব্‌সের লেখা পড়ে দ্যাখ! স্পষ্ট এই বইয়ের প্রভাব লক্ষ্য করবি।[৩] এগুলা তো সব নন-ফিকশান গেল, ইভেন ফিকশানেও এটার ছাপ দেখবি।”

“তাই নাকি? যেমন?”

“এই ধর…এডগার রাইজ বারোজ, রুডইয়ার্ড কিপলিং, ড্যানিয়েল ডিফোর টারজান, মউগলি, রবিনসন ক্রুসো এই বই তিনটা তো বিশ্ববিখ্যাত। হতে পারে যে তিনটাই ইবন তুফাইলের বই থেকে অনুপ্রাণিত।[৪] অথচ আমরা মুসলিমরা তাদের তিনজনের ভক্ত হলেও ইবন তুফাইলের মতো মহান মানুষকে চিনি না। জন লকের একটা লেখা আছে An Essay Concerning Human Understanding নামে। আধুনিক ওয়েস্টার্ন ফিলোসফির এমপিরিসিযমের মূল সোর্স বলা চলে। সরাসরি ইবন তুফাইলের লেখা থেকে অনুপ্রাণিত। আবার উনার ‘টাবুলা রাসা’ আইডিয়ার ডেভেলাপমেন্টেও বইটার সরাসরি প্রভাব আছে।[১৪][২৫] আরো শুনবি? কার্ল মার্ক্স, জর্জ বারকিলি, ডেভিড হিউম,[১৭] উইলিয়াম মলিনো[১৮], গটফ্রিড লাইবনিয, বারুখ স্পিনোযা[১৫], জঁ জাক রুসো, ভল্টেয়ার[১৬], ক্রিস্টোফার হাইগেনস, জন ওয়ালিস[৫], অ্যালেক্স্যান্ডার পোপ[২৬]…। এক বাক্যে বললে, Hay is the first, best and most influential novel ever written”[২৫]

আমি আর তারিক সিনানের দিকে হা করে তাকিয়ে আছি। এমন সময় স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। আমি ব্যাগ রেখে বসলাম, অবশেষে।

টিফিন টাইমে তারিক সিনানকে বলল, “বল এবার জীবন্ত কাহিনী!”

সিনান ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার ভাব করে বলল, “ঐটা কি আবার!”

“আরে হাই ইবন ইয়াকযানের গল্প বল না রে তুই…”

মুচকি হাসি নিয়ে সিনান বলতে শুরু করল, “হাই একটি নবজাতক, যে নির্জন দ্বিপে একা। সেখানে একটি হরিণ তাকে বড় করল এবং প্রকৃতি প্রদত্ত জ্ঞান থেকে সে সব শিখল। অন্য প্রাণীদের মত না হয়ে সে বুঝতে পারল তার উলঙ্গতা ও নিজের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা না থাকার কথা। তাই সে লতা-পাতা দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিল এবং নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করল”

“ওয়াও! নির্জন দ্বীপে থেকেও বুঝতে পারল যে নিজের শরীরকে ঢেকে রাখতে হয়? তাও কেউ শিখানো ছাড়া? আজকাল তো অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষও এটা বুঝতে চায় না!”

“এরপর শোন। পশুদের দুই পায়ের তুলনায় নিজের দুই হাতের ইউনিকনেস টের পায় সে। একসময় তার মা হরিণী মারা যায়। এ থেকে সে বুঝে নেয় যে, পশুদের একটা আত্মা থাকে। দেহকে এটা শুধুই একটি যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। প্রকৃতি নিয়ে গভীর চিন্তা করে করে সে বিভিন্ন জিনিস আলাদা করতে শেখে। মানে পশু, গাছ, খনিজ এগুলা আরকি। সব জিনিসের দেহ বা body আছে না?”

“এটা তো সবাই জানে!” বোকার মতো বললাম আমি।

“আরে দেহ মানে পৃষ্ঠ আরকি। এগুলার কার্যপদ্ধতি কিন্তু একটা আরেকটা থেকে আলাদা। এটাও হাই ধরতে পারে। আবার প্রত্যেকেরই নির্দিষ্ট আকার আর আলাদা ফাংশনালিটি থাকবে। এটাই হল আত্মা। কিন্তু এই আত্মা দেহ পেল কীভাবে?”

“আল্লাহ দিয়েছেন আরকি।” আবারও বললাম।

“ওইটা তো আমরা জানি।” সিনান বলল, “এখানে তো হাইকে নিয়ে কথা হচ্ছে।”

“ও হ্যাঁ, রাইট।”

“তো নিশ্চই আত্মাটা কেউ তাকে দিয়েছে। এভাবে হাই একজন অনন্য সত্তার কথা চিন্তা করল, যে প্রত্যেককে ভিন্ন ভিন্ন গুণাবলি দিয়েছে। সে আবার চিন্তা করল, এই অনন্য সত্তা তাহলে কোত্থেকে এলো আবার? যুক্তিচিন্তার মাধ্যমে বুঝতে পারল, তার সৃষ্টিকর্তা থাকলে আবার সেটিরও আরেকটি সৃষ্টিকর্তা লাগবে। এমন হলে তো এক অসিমধারা চলতে থাকবে। তাই সে সত্তা একজনই, অনন্য। এমন চিন্তভাবনা করতে করতে সে অনেক কিছু সঠিকভাবে বুঝে নিল। এমন সময় পাশের বসতিপূর্ণ দ্বীপ থেকে আবসাল নামের একজন সাধু এসে হাইয়ের সাথে দেখা করল। ওই দ্বীপের রাজা সালামান। আবসাল, হাইকে, মানে প্রকৃতির এই সন্তানটিকে কুর’আনের কথা জানাল। তারা দুজনে ঈশ্বর, প্রকৃতি ও নৈতিকতা নিয়ে লম্বা আলাপ চালাল। আবসাল অবাক হল, ঐশ্বরিক বাণী হতে সে যা শিখেছে, হাই দেখা যাচ্ছে সেসব শুধু যৌক্তিক চিন্তার মাধ্যমেই বুঝে ফেলেছে! হাই আবার নিজের বুদ্ধিমত্তা থেকে সাথে সাথে বুঝতে পারল যে, কুর’আনের শিক্ষাগুলো সত্য। এরপর তারা দুজনই একমত হলো যে, ধর্মের যৌক্তিক ব্যাখ্যা আর ফিলোসফির স্বাধীন চিন্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এটা সাধারণ জনগণকে জানানোর জন্য তারা পাশের শহরে গেল। কিন্তু গোঁড়া মানুষরা তাদের কথা বিশ্বাস তো করলই না, উলটো প্রচলিত বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে রাখল। হাই, যে এর আগে কখনো মানুষদের মাঝে আসে নি, মনে করল যে মানুষরা সাধারণত স্বার্থপর, লোভী আর নিজ প্রবৃত্তির কাছে নত। এসব মানুষ যুক্তি ও বিশ্বাস কে গুরুত্ব দেয় না। এরা কি ফিলোসফি বুঝবে? এদের সাহায্য প্রয়োজন। যার জন্য প্রয়োজন ধর্ম। এরা নিজের চিন্তা নিজে করতে পারবে না। এই শিক্ষার পর তারা দুজনে আবার নির্জন দ্বীপে এসে চিন্তা ভাবনা আর আল্লাহর ইবাদত করতে থাকল।

এই আরকি কাহিনি।” [৬]

“বুঝলাম,” আমার কণ্ঠে অনিশ্চয়তা। “কিন্তু এই ফিলোসফি-টিলোসফি এগুলো সব ইসলামের সাথে যায় তো?”

সিনান বলল, “ভালো পয়েন্ট ধরেছিস। ইবন তুফাইলের আক্বিদা আসলে কিছুটা ভেজাল মিশ্রিত। তিনি মুওয়াহিদ স্পেইনের মানুষ ছিলেন। আর সত্যি বলতে কী, আলমোহাদদের আক্বিদায় সমস্যা আছে। তারা ফিলোসফিকে বেশিই গুরুত্ব দিত। যেমন মুওয়াহিদদের বিশ্বাস ছিল যেসব মানুষদের ফিলোসফি বোঝার সামর্থ্য নেই, তাদের কুর’আন পড়ারও যোগ্যতা নাই।”

“ধুর! তাহলে গ্রাম্য বেদুইনরা কি কুরআন পড়বে না?” আমি বললাম।

“কথা ভুল বলিস নি। তবে আমার স্বভাব নিরপেক্ষ থাকার। একটু ইবন তুফাইলের চোখে ব্যাপারটা দেখি। আসলে, অনেকেই সরাসরি কুরআন পড়তে গিয়ে উল্টাপাল্টা বুঝে ভুল কাজ করে বসে। তারা তাফসির দেখে না, নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। উসুল আত-তাফসির নিয়ে কোন আইডিয়া থাকে না তাদের। তাই মুওয়াহিদদের এই বিশ্বাস একেবারে ফেলনা না। স্বাধীনভাবে কুরআন পড়ার আগে নিজের যোগ্যতা বানিয়ে নেওয়া উচিত।

যাহোক, ইবন তুফায়ল এর বইয়ের মূল শিক্ষা হচ্ছে, সঠিক ভাবে পরিচালিত যুক্তিচিন্তা, যা কু-প্রবৃত্তিহীন ও লোভহীন, ধর্মীয় বিশ্বাসেই পরিণত হয়। যুক্তি ও ধর্ম একে অপরকে পরিপূর্ণ করে।[১২]বর্তমানের ক্ষেত্রে একদা আইনস্টাইন যেমন বলেছিলেন, “science without religion is lame, religion without science is blind[১৩]।

আরেকটা ব্যাপার আছে শোন, মানুষ তার যৌক্তিকতা ব্যবহার করে কুরআনে আল্লাহ আমাদের যে উদ্দেশ্যে উদ্যত হতে বলেছেন, সে পর্যন্ত যেতে পারবে — এ ধারণা মূলত দিতে চাচ্ছেন ইবন তুফাইল। কুরআনে যে নৈতিকতা বর্ণিত আছে, আল্লাহ আমাদের স্বাভাবিক রূপ সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন — যা হল ফিতরাহ। যখন মানুষ বিপথে যায়, তখন ফিতরাহ এর বিরুদ্ধে কাজ করে যায়।[২৫] সুতরাং নির্জন দ্বীপে কোন নেতিবাচক প্রভাব ছাড়া একজন মানুষ তার ফিতরাহকে অনুসরণ করে সে পর্যন্ত যেতেই পারে। ইবন আল-নাফিস ইসলামের একজন ‘আলিম[২০] হওয়ার পরেও একদম এমনই দেখিয়েছেন — বরং আরও বোল্ডলি দেখিয়েছেন।[১৯] তাই এই ধারণা কনসিডার করা যায়। কিছু মডার্নিস্ট মুসলিম বলতে চেয়েছেন যে ইবন তুফাইল এখানে একরকম সেক্যুলার ভাবধারার বয়ান দিয়েছেন। কিন্তু আসলে ইবন তুফাইল সুফিবাদের দিকে ইঙ্গিত করেন, বইয়ের পরিণতি ক্লিয়ারলি তাই নির্দেশ করে।[২১] এই বইয়ের মর্মার্থ এই নয় যে reason is better than religion, বরং reason leads to religion”[২২][২৩]

“That’s just sick! অস্থির ব্যাটা” তারিক বলল, “ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ থেকেও আমরা এমন তত্ত্ব পাই। তিনিও সুস্থ যুক্তি আর ওয়াহয়ি এর মাঝে কোন বিরোধ নেই — এমন দেখিয়েছেন। তিনি আল্লাহর এমন এক বর্ণনা দেন, যা তার বিশ্বাস, কুরআন-হাদিস দ্বারা সমর্থিত। কিন্তু তিনি এর জটিল ফিলোসফিকাল ব্যাখ্যাও দেন! তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে, দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও শেষমেশ আমরা একই জায়গায় পৌছাই![২৪] এটা কনসিডার করার কিছু না বরং এটাই ঠিক। ইবন তাইমিয়্যা এটা একদম প্রমাণ করে দেখিয়েছেন”[২৭]

কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল সিনান, “কিরে তারিক! ইবন তাইমিয়্যাহ স্টাডি করিস তুই?!”

“তুই করিস না? পড়িস পড়িস, ভয়ংকর মজা ব্যাটা”

“Okay أَخِي

“আর শুন, উপরে যেরকম বললি, একাকি একজনকে দ্বীপে রেখে দিলে সে নিজ থেকে কোনরকম ডিভাইন কোন কিছু ছাড়া আল্লাহকে পেয়ে যাবে, সেটাও ইবন তাইমিয়্যা বলেছেন”[২৯]

“জিনিসটা তো খুবই সেরা ব্যাটা!” আমার রিমার্ক দিয়ে টিফিন টাইম শেষ হল।

আমরা ক্লাসে ঢুকলাম।

ছুটির পর আমরা তিনজন হেঁটে হেঁটে বাসায় যাচ্ছি। সিনান বলল, “সবই ভালো। শুধু একটা জিনিস বুঝলাম না যে, ইবন তুফাইল এত ভালো একটি উপন্যাস একা কীভাবে লেখলেন। গবেষণায় নামলাম। দেখতে পেলাম যে না, উনি একা, সম্পূর্ণ নিজ হতে লেখেননি।”

“তো?”

“হাই ইবন ইয়াকযান নামে ইবন সিনারও একটি গল্প ছিল। ইবন সিনার আরও একটা গল্প আছে সালামান ওয়া আসাল নামে। ইবন তুফাইলের বইয়ের নাম দুইটাও এগুলোই। আবার, এই গল্পেও একটি হরিণও ছিল! অবশ্য, ইবন সিনার লেখা গল্প আর ইবন তুফাইলের লেখা গল্পে বিরাট ফারাক। তবে প্রায় সব মুসলিম ফিলোসফারের লেখা গল্প আসলে ‘Ibn Sina Recycled’।[৭] ইবন তুফাইল ছাড়াও ইবন আল-নাফিস, আবু হামিদ আল-গাযালী, শিহাবুদ্দিন সুহরাওয়ারদি সহ অনেকে আছে। ইবন তুফাইলের বইটার উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে ইবন বাজ্জাহর তাদবির আল-মুতওয়াহহিদ বই। আসলে হাই ইবন ইয়াকযান ঐ কল্পিত চরিত্রটির চরম রূপ ছাড়া আর কিছুই না। তবে ইবন বাজ্জাহর ওই চরিত্রটি অসম্পূর্ণ ছিল। । তাই আবু হামিদ আল-গাযালির থেকে প্রভাবিত হয়ে তিনি চরিত্রটিকে পূর্ণতা দান করেন, হাই ইবন ইয়াকযান হিসেবে। আর হ্যা, কুরআনে ইব্রাহিম আলাইহিসসালাম এর ঘটনা থেকেও ভালোভাবে প্রভাবিত ছিলেন ইবন তুফাইল।[২৮] হুনাইন ইবন ইসহাকের অনুবাদ করা একটা গ্রিক টেক্সটেরও প্রভাব আছে ইবন তুফাইলের উপর। আসলে এটার সাথে ইবন তুফাইলের গল্প অনেকটাই মিলে। আর সম্ভবত আলেক্সান্দ্রিয়ান আর পার্সিয়ান প্রভাবও আছে।”

“ধুর ব্যাটা!” বলল তারিক, “ভাবলাম ইবন তুফাইলের অরিজিনাল কাজ। এখন তো দেখি পুরাই জাফর ইকবাল!”[১১]

“উঁহু। দ্বিমত। লেখার ফুল ক্রেডিট ইবন তুফাইলের। তুই দ্যাখ এ পর্যন্ত যেসব বইয়ের কথা বলেছি, সবই সিম্পল গল্প। তেমন বিশেষত্ব নেই। কিছু সিম্পল গল্প থেকে ইবন তুফাইল অসাধারণ একটা ফিলোসফিকাল উপন্যাস বানিয়ে ফেলেছেন। এর জন্য ভালো দক্ষতা আর উচ্চমানের চিন্তাধারা লাগে।

শোন, শেক্সপিয়ারের The Merchant of Venice খুব বিখ্যাত নাটক। কিন্তু ১৯৫৬ সালে, শেক্সপিয়ার এটা লেখার ১৭ বছর আগেই নাটকটা স্টেজড হয়। তারও আগে এমনই একটি বই পাওয়া যায় সার জিওভানির লেখা। ১৫৫৮ সালে প্রকাশিত। শেক্সপিয়ারের বইয়ের কাহিনীর সাথে হুবহু মিলে যায়। আবার শাইলকের চরিত্র তিনি ধার করেন বিখ্যাত সাহিত্যিক মার্লোর জু অফ মাল্টা থেকে।[৮] তো শেক্সপিয়ারের বইটি কোনভাবেই অরিজিনাল না। কিন্তু এভাবে কি বলা হয় কোন সময়? এতে কি শেক্সপিয়ারের সম্মান কমানো হয়? না! সাহিত্যে এমন রেগুলারলি হয়। এটা নিয়ে সমালোচনা করা মানে সমালোচকের সাহিত্যিক জ্ঞানের অভাব।

শেক্সপিয়ারেরটা অসাধারণ, অন্য লেভেলের সাহিত্য, মানলাম। কিন্তু ইবন তুফাইল যে চমৎকার দর্শন ও বৈজ্ঞানিক বর্ণনা দিলেন, এটার আলাদা ক্রেডিট নেই? তাও আবার ইবন সিনার বই আর হাই ইবন ইয়াকযান এর মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ইবন সিনার বইটি, আসলে অনেকটা প্রাবন্ধিক লেখার মতই, সাহিত্য বলতে কিছুই নেই তাতে[১০]।

এজন্য ফিলিপ কে হিট্টির মতো বড় স্কলার কোনরকম কথা না বলেই ইবন তুফাইলের বইটাকে অরিজিনাল বলেছেন”[৯]

“অ। তাহলে তো ঠিকই আছে।” তারিক বলল।

সিনান বলল, “লাস্ট আরেকটা কথা। বইটা আবু হামিদ আল-গাযালির লেখা তাহাফুত আল-ফালাসিফার একটা জবাব। ইংরেজি করলে হয় Incoherence of the Philosophers। ইবন তুফাইল, আবু হামিদ আল-গাযালীর সমালোচনা করেছেন যদিও তিনি নিজেই তার থেকে অনুপ্রাণিত। আসলে ঐ সময় এখনকার মতো সমালোচনা মানেই শত্রুতা ছিল না। একজন অন্য জনের সমালোচনা করলেও তার ভাল গুলো গ্রহণ করতে কুণ্ঠা বোধ করত না।”

আমি মনে মনে ভাবলাম, ইবন তুফাইল আসলে বইটাকে মাস্টারপিস বানানোর চেষ্টাই করেননি। পরে জেনেছিলাম তিনি কোনো পেশাদার লেখক ছিলেন না। ডাক্তার আর ক্বাদি বা শারিয়াহ জাজ ছিলেন। শুধু ইমাম আল-গাযালীর সমালোচনা লেখতে চেয়েছিলেন কিছুটা সাহিত্যিক স্টাইলে। সুন্দর করতে গিয়ে তিনি এমন এক বই লেখে ফেলেছেন, যা ইউরোপ পাল্টাতে ভূমিকা রেখে দিয়েছে!

Notes:

1. G. A. Russell, The ‘Arabick’ Interest of the Natural Philosophers in Seventeenth-Century England. (Brill Publishers, 1994) p. 228

2. G. J. Toomer, Eastern Wisedome and Learning: The Study of Arabic in Seventeenth-Century England (Oxford University Press, 1996) p. 218

3. Samar Attar, The Vital Roots of European Enlightenment: Ibn Tufayl’s Influence on Modern Western Thought (Lexington Books, 2010)

4. Cyril Glasse, New Encyclopedia of Islam (Rowman Altamira, 2001) p. 202;

5. G. A. Russell (1994), The ‘Arabick’ Interest of the Natural Philosophers in Seventeenth-Century England, pp. 224–239 ; 6. মূল বইটি পড়তে উৎসাহিত এবং বাংলা অনুবাদ পড়তে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। গ্রন্থপঞ্জীর বইটি রেকোমেন্ডেড

7. Sarah Stroumsa“Avicenna’s Philosophical Stories: Aristotle’s Poetics Reinterpreted” available at: https://booksc.xyz/book/11397170/e5b9a6

8. “Introduction” in William Shakespeare, The Merchant of Venice (Penguin Books, 1999)

9. Philip K. Hitti op. cit. p: 582

10. Abu Ali ibn Sina, Risalah Hayy ibn Yaqzan (Tr. Form French by W.R. Trask, Princeton, NJ, 1990) in S.H. Nasr and M. Aminrazavi op. cit.

11. একটা আইডিয়া পেতেঃ

12. Dr. Ibrahim Kalin. “ ‘Hayy ibn Yaqdhan’ and the European Enlightenment” Daily Sabah.

13. Science, Philosophy and Religion, A Symposium, published by the “Conference on Science, Philosophy and Religion in Their Relation to the Democratic Way of Life, Inc.”, New York (1941); later published in Out of My Later Years (1950)

14. The Royal Society. “Arabic Roots” June 2011.

15. Martin Wainwright, “Desert island scripts” The Guardian, 22 March 2003.

16. Tor Eigeland, “The Ripening Years” Saudi Aramco World, September–October 1976.

17. Dominique Urvoy, “The Rationality of Everyday Life: The Andalusian Tradition? “ in Lawrence I. Conrad (), The World of Ibn Tufayl: Interdisciplinary Perspectives on Ḥayy Ibn Yaqẓān(Brill Publishers, 1996) pp. 38–46.

18. Diana Lobel (), A Sufi-Jewish Dialogue: Philosophy and Mysticism in Baḥya Ibn Paqūda’s Duties of the Heart (University of Pennsylvania Press, 2006) P: 24

19. পড়ুন “ইবন আল-নাফিসের কৃতিত্ব”.

20. আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, ইলমের ভালবাসায় চিরকুমার উলামায়ে কেরাম (অনুবাদঃ আবু সাঈদ মুহাম্মদ নু’মান, মাকতাবাতুল আযহার, ২য় প্রকাশ ২০১৯) পৃষ্ঠাঃ ১৭৭ — ১৮৩।

21. Dr. Abu Shadi al-Roubi (1982), “Ibn Al-Nafis as a philosopher”, Symposium on Ibn al-Nafis, Second International Conference on Islamic Medicine: Islamic Medical Organization, Kuwait; available at: http://www.islamset.com/isc/nafis/drroubi.html

22. Oussama Hamza. “Alive and Awake: The First and Greatest Novel” The Muslim 500 (2020) p: 202–204.

23. ইবন তুফাইলের বইয়ের শিক্ষা ও দর্শন এই গল্পে আলোচ্য নয়। তার জন্য অবশ্যই আলাদা গল্প/লেখা লাগবে। এখানে শুধু একটু স্বাদ দেওয়া হল। আল্লাহ তৌফিক দিলে ভবিষ্যতে লেখা যাবে।

24. Jon Hoover. “Perpetual Creativity in the Perfection of God: Ibn Taymiyya’s Hadith Commentary on God’s Creation of This World” Journal of Islamic Studies 15:3 (2004) pp. 287–329.

- Jon Hoover. “Fitra” in Encyclopedia of Islam (3rd edition, Leiden: Brill Publishers)

25. জিনিসটা ইসলাম বিরোধী হলেও, আশ’আরি চিন্তাভাবনায় ফিতরার ব্যাপারে ধারণা এর মতোই (গাযালী, ফাখর রাযী)।

26. Samar Attar, The Vital Roots of European Enlightenment op. cit. p: 20

27. Carl Sharif el-Tobgui, Ibn Taymiyya on Reason and Revelation: A Study of Darʾ taʿāruḍ al-ʿaql wa-l-naql (Leiden: Brill, 2020)

- Yasir Kazi [Qadhi], “Reconciling Reason and Revelation in the Writings of ibn Taymiyyah (d. 728/1328): An Analytical Study of ibn Taymiyyah’s Dar al-Ta’arud” (PhD Dissertation, Yale University, 2013)

- বাংলায় একটা আইডিয়া পেতে চাইলেঃ আরমান ফিরমান, “যুক্তি ও ওয়াহয়ি এর মাঝে ইবন তাইমিয়্যাঃ কার্ল শারিফ আল-তোবোগুই ও ইয়াসির ক্বাদির ডক্টরাল থিসিসের একটা ওভারভিউ” available at: medium.com/@armanfirman

28.Yasir Kazi, p: 293.

29. Carl Sharif el-Tobgui, p: 261.

Post a Comment

0 Comments