বুদ্ধিবৃত্তিক চৌর্যবৃত্তি ৮






ব্লেইস প্যাসকেল খুবই বিখ্যাত একজন মানুষ। স্কুল-কলেজ ম্যাথ বইয়ে আমরা ‘প্যাসকেলের ত্রিভুজ’ পড়ি। ফিজিক্স বইয়ে তো অনেক কিছুই আছে প্যাসকেল কে নিয়ে। কেমিস্ট্রিতেও এনাকে দেখা যায়। প দিয়ে প্যাসকেল, প দিয়ে প্যারা — এমন ধারণা কোন শিক্ষার্থীর থাকাটা অস্বাভাবিক না। তবে, প্যাসকেল কানেক্টেড জিনিসগুলো সহজ আছে, তাই সম্ভবত প্যাসকেলেরত প্রতি কারো বিরূপ মনোভাব নেই।

আর আবু হামিদ আল-গাযালী। হুজ্জাত আল-ইসলাম। বর্তমানে মুসলিমদের মধ্যে যাদের চিন্তাধারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালি তারা হলেন আবু হামিদ আল-গাযালি, ইবন তাইমিয়্যা আর জালালুদ্দ্বিন রুমী[i]। আর অ্যাকাডিমিয়ায় (ওয়েবসাইট) যে আল-গাযালির ফলোওয়ার গবেষকের সংখ্যা ইবন সিনা থেকে ৩০০০ বেশি, সেটা সত্যি শকিং। কেননা ইবন সিনার ক্ষেত্রে দর্শন ও বিজ্ঞান দুইটাই আছে, যেখানে গাযালির ক্ষেত্রে কেবল দর্শনই আছে। তার দর্শন কতটা হাই লেভেলের হলে ইবন সিনা থেকে ফলোওয়ার তিন হাজার বেশি হতে পারে — ভাবার বিষয়।

তাইলে লেখা বড় করার ধান্দাবাজি শেষে মূল্ আলোচনায় ঢোকা যাক। ফোকাসে প্যাসকেল (d. 1662) এর লা পেনসিস (Thoughts) বই থাকবে।


ওয়েস্টে মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের প্রভাব নিয়ে সেরা কাজ করেছেন মিগেল আসিন পালাশিয়োস। তিনি বলেন, পরকাল নিয়ে গাযালি আর প্যাসকেল এর চিন্তাধারার মাঝে যে মিল রয়েছে, তা কাকতালীয় হতে পারে না।[ii] গাযালি যেসব কথাবার্তা ব্যবহার করেছেন ইসলামকে ডিফেন্ড করেছেন, একই অস্ত্র ব্যবহার করে প্যাসকেল ক্রিসচিয়ানিটিকে ডিফেন্ড করেছেন।[iii] logic of the heart নামে প্যাসকেলের একটা থিওরি আছে, যার মূল ফাউন্ডেশন দেখা যায় eye of the heart নামে গাযালির একটা থিওরিতে। দুইজন হুবহু একই কথা বলেনঃ God is felt not in the intellect but in the heart।

মেইন যেসব জিনিসে প্যাসকেল আর গাযালির মধ্যে মিল পাওয়া যায়ঃ ওয়াহয়ি এর ঈশ্বর কে প্রেফার করে দার্শনিকদের ঈশ্বরের বর্ণনা কে রিজেক্ট করা, কোন কোন ক্ষেত্রে যুক্তি ব্যবহার করা যাবে তা ডিফাইন করা, ওয়েজার আর্গ্যুমেন্ট, যুক্তির সীমাবদ্ধতা ও প্রাকৃতিক ভাবে প্রাপ্ত জ্ঞান (ইলহাম — intuitive knowledge) এর প্রয়োজনীয়তা, থ্রি অর্ডার্‌স আর function of formal worship।[iv]

মিগেল আসিন পালাশিয়োস প্যাসকেলের ওয়েজার[v] স্পষ্ট দেখতে পান গাযালির মিযান আল-আ’মাল আর ইহয়া উলুম আল-দ্বীন এ। এটা অবশ্য গাযালির টিচার আবুল মা’আলি জুয়াইনির মধ্যেও পাওয়া যায়।[vi]

প্যাসকেল বলেন, অবিশ্বাসের সমস্যা সমাধানের জন্য অঞ্জেক্টিভ আর্গ্যুমেন্ট, ইন্টেলেক্ট আর ফেইথ এর উপর নির্ভর করে লাভ নেই। সমস্যা সমাধানে তিনি যেসব বলেছেন, সেসব প্রায় কোনরূপ পরিবর্তন ছাড়া গাযালির মিযান, ইহয়া আর আরকান আল-আরবাইন এর সাথে মিলে।[vii]


মিগেল আসিন পালাশিয়োস এরকম ১১ টা প্রায় হুবহু কপির ইন্সট্যান্স দেখিয়েছেন কেবলমাত্র প্যাসকেলের ওয়েজার আর্গ্যুমেন্ট এর ক্ষেত্রে। তিনি মিল দেখিয়েছেন গাযালির মুনকিজ, ইহয়া, মিযান, আরবা’ইন, মুসতাশফা, ফায়সাল থেকে। ম্যারি হোসেইন বিভিন্ন দিকে আরও অনেক মিল দেখিয়েছেন যার বেশিরভাগ মুনকিজ এর সাথে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ল্যাটিনে কোনগুলো অনুবাদ হয়েছিল আর প্যাসকেলের অ্যাক্সেস ছিল কোনগুলোর প্রতি।

বিখ্যাত গাযালি স্কলার ফ্র্যাঙ্ক গ্রিফেল বলেন, ১৬শ শতক থেকে ওয়েস্টার্ন দার্শনিকরা গাযালির ব্যাপারে জানতো, অন্তত এতটুকু জানতো যে গাযালি অ্যারিস্টটলিয়ান ফিলসফির ক্রিটিক আর জানতো কার্যকারণ (causality) সম্বন্ধে তার সন্দেহমূলক সমালোচনার ব্যাপারে।[viii] পালাশিয়োস বলেন, প্যাসকেল ওরিয়েন্টালিস্ট ড’হার্বেলট কে চিনে থাকতে পারেন, যে গাযালির কিছু লেখা সে সময়ে অনুবাদ করেছিল। তবে এটা থেকে প্যাসকেলের পড়াটা অসম্ভাব্য কারণ সে যেসব অনুবাদ করেছিল তার সাথে প্যাসকেলের লেখার মিল নাই। তবে ফ্র্যাঙ্ক গ্রিফেল বলেন, যদি ড’হার্বেলট সে সময়ে মুনকিজ পড়ে অনুবাদ করতে পারে, অন্যান্য অনেক স্কলারও এর অনুবাদ করতে পারে। সেটা অবশ্য, ধারণাই থেকে যাবে, ডেটা না থাকায়। আশার আলো নিয়ে ম্যারি হোসেইন এখানে বলেন, র‍্যামন মারটি নামক একজন স্কলার গাযালির লেখা সে সময় অনুবাদ করেছিল তার পুজিও ফিডেল বইয়ে। ১ আর ৫ নাম্বার অধ্যায় পুরোপুরি মুনকিজ থেকে অনুবাদ করা। আর, প্যাসকেল এটা পড়েছেন শুধু এমন না, সরাসরি পেনসিস এর ২৭৭ আর ৪৩৩ নং পেজে এর নাম পর্যন্ত নিয়েছেন![ix] জন বোডিন, ১৬শ শতকের একজন প্রভাবশালি ফ্রেঞ্চ দার্শনিক তার একটা বইয়ে গাযালির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, এমনকি ইবন রুশদ থেকেও গাযালির চিন্তাধারাকে সেরা বলেছেন।[x] আর যখন আগের শতকের একজন প্রভাবশালি দার্শনিক একজন নির্দিষ্ট দার্শনিকের প্রশংসা করে, তখন পরের শতকের দার্শনিকদের তার ব্যাপারে না জানা আর তার লেখা না পড়া একেবারেই অস্বাভাবিক হয়ে উঠে।


লা পেনসিস একটা অসম্পূর্ণ কাজ। বইটার মধ্যে অযাচিত ভাবে ইসলামকে পচানো হয়েছে। তবে এল. এম. হেলার বলেন, যদি প্যাসকেল আরও সময় পেতেন আর আরও ভালোভাবে স্টাডি করে ইসলাম বুঝতেন, তাইলে ইসলাম নিয়ে উল্টাপাল্টা কথাগুলো বলতেন না।[xi] ৩৯ বছর বয়সে প্যাসকেল মারা যান।


References:

[i] Peter Adamson, Philosophy in the Islamic World: A History of Philosophy without any Gaps (Oxford University Press, 2016) location 7943.

[ii] M.M. Sharif, (edt), A History of Muslim Philosophy (Allgauer Heimatverlag, 1963) vol. 2, p. 584.

[iii] Mary Hossain (1991), “Pascal and Islam”. Journal of Islamic Studies, 2:2, 180–194.

[iv] Mary Hossain (1984), “Pascal and al-Ghazālī”. Seventeenth-Century French Studies, 6:1, 151–163, DOI: 10.1179/c17.1984.6.1.151

[v] ঈশ্বর না থাকলে মৃত্যুর পর চরম শূন্যতা — বিশ্বাসীর সমস্যা নাই। কিন্তু ঈশ্বর থাকলে অবিশ্বাসী তো মৃত্যুর পর ধরা খাবে — এটাই।

[vi] Imam al-Haramayn al-Juwayni, A Guide to Conclusive Proofs for the Principles of Belief (UK: Garnet Publishing, 2000) pp. 6–7.

[vii] M.M. Sharif op. cit. p. 586.

[viii] Frank Griffel, “The Western Reception of al-Ghazali’s Cosmology: from the Middle Ages to the 21st century” available at: https://bit.ly/3hf1OBA

[ix] Mary Hossain. “Pascal and Ghazali” op. cit.

[x] Frank Griffel op. cit.

[xi] Mary Hossain (1991), “Pascal and Islam”. op. cit.





Post a Comment

0 Comments