মুসলিম বিশ্বে নন-মুসলিম মাইনরিটির প্রতি (নন-)মুসলিমদের আচরণ



ইহুদীদের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ফিলোসফারদের একজন, যদি না সর্বশ্রেষ্ঠ হন – মুসা ইবন মাইমুন বা Maimonides (Moseh ben Maymon)। তিনি ‘ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন’। 

না, আসলে করেননি। স্পেইন থেকে মিশরে পালিয়ে গিয়ে নিজেকে ইহুদী ঘোষণা করেন। তার জীবনের শেষের দিকে ইসলামের একজন আলিম তাকে মুরতাদ বলে আখ্যায়িত করেন এবং এর জন্য কঠোরতম শাস্তি দাবী করেন। স্বাভাবিকভাবেই, এটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা ছিল কারণ সেটা মুসলিম সাম্রাজ্য। কিন্তু এমনই সময় ক্বাদি আল-ফাদিল আব্দুর রাহিম ইবন আলী, যিনি ইসলামের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্বাদিদের একজন এবং সালাহ আল-দ্বীন আয়্যুবীর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, প্রমাণ করে দেখালেন যে মাইমনিডিস কে জোর করে মুসলিম বানানো হয়েছিল এবং এমন মানুষকে মুসলিম বলা যায় না। মাইমনিডিস কোন সময় ইসলাম গ্রহণই করেননি। সুতরাং তাকে মুরতাদ বলার কোন সুযোগই নেই।[১] উল্লেখ্য, মুসা ইবন মাইমুন, সালাহ আল-দ্বীন আয়্যুবীর পারসোনাল ফিজিশিয়ান ছিলেন। 

আসলে, মুসলিম বিশ্বে নন-মুসলিমরা আক্রমণের শিকার হয়েছে নন-মুসলিমদের থেকেই, মুসলিমরা তো চরম উদার ছিলেন, অতিরিক্ত উদার [১]। 

তো এই মুসা ইবন মাইমুন, মুসলিমদের কাছে জাস্টিস পেলেও পেলেননা তার স্বধর্মের মানুষদের কাছে। মন্টপেলিয়ের-এর র‍্যাবাই সলোমন বেন আব্রাহাম তার ও তার বইগুলোর শক্ত বিরোধিতা করেন। লোকসমাগম জায়গায় তার সবগুলো বই জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ১২৩৪ সালে মন্টপেলিয়েরে এবং ১২৪২ সালে প্যারিসে। সকলের সামনে, উৎসবমুখর পরিবেশে[২]। 


মুসলিম বিশ্বের সেরা অনুবাদক, (খৃষ্টান) হুনাইন ইবন ইসহাক (b. 809) নিজেই লেখেন যে অন্যান্য খৃষ্টানরা তাকে কিরকম পিড়া দিয়েছিল। উদাহরণঃ অন্যান্য খৃষ্টানরা তাকে খোটা দিত বলে যে, ‘তুই তো শুধুই একটা অনুবাদক, কোন ডাক্তার না’। বিখ্যাত বুখতিষু পরিবারের ইউহান্না ইবন মাসাওয়ায়হ নিজে খৃষ্টান হওয়ার পরেও হুনাইন ইবন ইসহাক কে চিকিৎসা বিদ্যা শেখাননি, এ বলে যে তিনি ‘ইবাদ গোত্রের।[২] 

এই একই মানুষ, হুনাইন ইবন ইসহাক কে মুসলিমরা অত্যন্ত সম্মানের সাথে রাখে। আসলে মুসলিমদের জন্য বিভিন্ন বই অনুবাদ করেই তিনি এক ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।[৪] অন্যান্য খৃষ্টানরা তাকে গালাগালি করলেও, তিনি সবার থেকে সফল হয়ে দেখিয়ে দেন![১০]


পশ্চিমে যদি তাকাই, প্রাচীন গ্রিস এর প্লটিনাস আর পরফিরি এর সময় হতে প্যারাসেলসাস (১৫শ শতক) এর মাঝে, যে-ই বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে গিয়েছে, ল্যাক্রোয়া বলেন, তারই অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।[৫] তাদেরকে সর্বদাই ‘যাদুকর’ বলে ডাকা হতো (নেতিবাচক ভাবে, অবশ্যই)। কিছু কিছু সময় তো তাদের জীবনই ঝুকির মধ্যে পতিত হত।[৫] এসব নির্যাতিতদের মধ্যে রয়েছেন রেমন্ড লুল, রজার বেকন, এলবারটাস ম্যাগনাস, বভা-র ভিন্সেন্ট এবং আরও অনেকে। 

কেউ একজন বলতে পারেন যে এরা মুসলিম বিশ্বের না। এদের এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে কারণ এদের ‘আন্দালুসিয়ান’ বলা হত। এরা প্রত্যেকেই মুসলিম স্পেইন হতে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। যখন মুসলিম বিশ্বে আসেন, তখন শান্তিতে বিজ্ঞান সাধনা করতে পারেন, নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়েই ভুলটা করেন তারা।  

যাহোক, মূল পয়েন্টে ফিরে আসি আবার। আরাগন-এর হেনরি, বিশাল একটি লাইব্রেরী তৈরি করেন, আর তার স্বাজাতির মানুষরা তার হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফলকে সমস্ত জনগণের সামনে ভস্মীভূত করে। তাকে অপবাদ দেওয়া হয়, ‘তুই তো শয়তানের চ্যালা’[৬]।

 ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানে তার নিজের মানুষরাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মোরলে-র ড্যানিয়েল তার ‘ফিলোসফিয়া’ গ্রন্থে বলেন, “যখন প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার জন্য  নিজেকে  ইংল্যান্ড থেকে দুরে সরিয়ে নিয়ে যাই এবং প্যারিসে কিছু সময় অতিবাহিত করি, সেখানে আমি দেখতে পাই কিছু জানোয়ার যারা স্কলারলি চেয়ারে চরম ক্ষমতা নিয়ে বসে ছিল...এই উস্তাদগণ এমনই অজ্ঞ ছিল যে তারা মূর্তির মত স্থির হয়ে বসে থাকত, চুপ থাকার মাধ্যমে ভাব মারার চেষ্টা করত” ১১৭৫ সালের কিছু পরে তিনি লিখেন, “কিন্তু যখন আমি আরবদের মতধারার কথা শুনতে পাই...যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি সেখানে ছুটে যাই, যেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের কথা শুনতে পারি”।[৭] বাথ-এর এডেলার্ড বলেন, অ্যারাবিক বিজ্ঞান মজা আর ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞান বোরিং।[৮]



শেষবাক্যঃ সালাহ উদ্দিন জাযাইরী বলেন, মুসলিম বিশ্বে নন-মুসলিমরা শিক্ষার সর্বোচ্চ সম্মান এর চেয়ারও পেয়েছিল এবং প্রত্যেক নন-মুসলিম ইন্টেলেকচুয়ালই উঁচু পজিশন প্রাপ্ত হত, কিন্তু এখন, নন-মুসলিমরা যখন পৃথিবী চালায়, একটা বড় শিক্ষা পোস্টেও (যেমনঃ চ্যান্সেলর, ভাইস চ্যান্সেলর ইত্যাদি) কোন মুসলিমকে স্থান দেওয়া হয় না (২০০২ সালের হিসাব)। [৯]


Notes:
১। টি. ডব্লিউ. আর্নল্ড, "ইসলামে পরমতসহিষ্ণুতা" (ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৫৬ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ ২০১৭) চমৎকার চমৎকার উদাহরণের জন্য লেখাটি (১৩ পৃষ্ঠা) পড়ুন (must read!): https://archive.org/download/ScanApr172019/Scan%20Apr%2017%2C%202019.pdf

২। Will Durant,  The Age of Faith (New York: Simon and Shuster, 6th printing, 1950)  p. 415. 
৩। George Saliba, Islamic Science and Making of European Renaissance (The MIT Press, 2007) p: 62

৪। Ehsan Masood, Science and Islam - A History  (Icon Books, 2009) p: 48

৫। P. Lacroix, Science and Literature in the Middle ages, p: 204. as cited in Salah Eddin al-Djazairi, Hidden Debt to Islamic Civilization (MSBN Books, 2018) 

৬। Will Durant, op. cit. p: 426. 
৭। Anthony Pym, Negotiating the Frontier: Translators and Intercultures in Hispanic History  (Manchester: St. Jerome Publishing, 2000) p: 41

৮। Charles Burnett . “The Transfer of Science Between India, Europe and China via Muslim Heritage” Muslim Heritage.

৯। Salah Zaimeche . “An Introduction to Muslim Science”  Muslim Heritage.

১০। Emir-Stein এর এই ভিডিওটা দেখবেন, আর একটা শক খাবেন: https://www.youtube.com/watch?v=kzJojqPy7NQ&t=1s

Post a Comment

0 Comments