বুদ্ধিবৃত্তিক
চৌর্যবৃত্তি
Muslim
Ingenuity, Eurpean Theft
পর্ব
– ৩
রক্তের
পালমোনারি সার্কুলেশন
ইবন
আল-নাফিস – উইলিয়াম হার্ভি
----------------
ইবন আল-নাফিস। একজন আলিম্[i], একজন
বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের ইতিহাস অ্যাকাডেমিয়ায় কিভাবে বোম ফাটে সে ব্যাপারে একটা ধারণা
গত পর্ব[ii]
থেকে
হয়েছে আশা করা যায়। এক্ষেত্রেও সিমিলার কিছু একটা ঘটেছিল ১৯২৪ সালে। মুহিউদ্বীন আল-তাত্তাউয়ী
নামের একজন ইজিপসিয়ান ফিজিশিয়ান উনার ডক্টরেট করছিলেন ফ্রাইবার্গ এর অ্যালবার্ট লুডউইগ
ইউনিভার্সিটিতে। গবেষণার জন্য বার্লিনের প্রাসিয়ান স্টেট লাইব্রেরীতে অবস্থান করছিলেন
তিনি। এই সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ইবন আল-নাফিসের সেরা কাজ তার হাতে পড়ে যায়। ডক্টরেট
এর পরপরই মিশর সরকার তাকে কাজের জন্য গ্রামে পাঠিয়ে নিজের অজান্তেই ইবন আল-নাফিসের
বিজ্ঞানকে আবার বিলুপ্ত করার ব্যাবস্থা করে। ইবন আল-নাফিস বিজ্ঞান করতেন মিশরেই, আর
মিশর নিজ বিজ্ঞানীকে ভুলবশত নিজেরাই বিলুপ্ত করে দিচ্ছিল! কিন্তু বিখ্যাত ওরিয়েন্টালিস্ট
ম্যাক্স মেয়ারহফ রক্ষাকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। ইবন আল-নাফিসের টেক্সট নিয়ে ভালো মানের
কাজ করেন এমনকি ইবনুন নাফিসের পাণ্ডুলিপি অনেকগুলো ভাষায় অনুবাদ করে দেন, এবং যার ফলে
বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে।
ইবনুন নাফিস মানবদেহে রক্তের ফুসফুসীয় সংবহন বা রক্তের
সূক্ষ্ম সঞ্চালন বা পালমোনারি ট্র্যানসিট সবার আগে সঠিক ভাবে বর্ণনা করার জন্য খ্যাত[iii],
মানে, অ্যাট লিস্ট বিজ্ঞানের ইতিহাস অ্যাকাডিমিয়ায়। ইবন আল-নাফিস এর এ আবিষ্কারটা খুবই তুচ্ছ মনে হতে পারে।
কিন্তু, মাইকেল হ্যামিল্টন মরগান যেভাবে বলেন “শুন্যের ব্যাবহার প্রতিষ্ঠা গণিতে
যেরকম গুরুত্বপূর্ণ, ইবন
আল-নাফিসের ফুসফুস-ধমনীর মধ্যবর্তী রক্ত সঞ্চালন আবিষ্কার আধুনিক মেডিসিনে তেমনই
গুরুত্বপূর্ণ”।[iv]
ইবনুন নাফিসের কাজ ছাড়া সম্পূর্ণ রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বর্ণনা করা সম্ভব হত না।
‘বিজ্ঞানের ইতিহাস’ সাবজেক্টের জনক, জর্জ সারটন বলেন, ইবন
আল-নাফিসের ব্যাপারটা সত্য প্রমাণিত হলে তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা বিজ্ঞানীদের
একজনে পরিণত হবেন।[v]
এখন তা প্রমাণিত এবং এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই।[vi]
উইলিয়াম হার্ভির কৃতিত্ব এই যে, ইবন আল-নাফিস শুধু ফুসফুস-হৃদপিণ্ডতে রক্ত সঞ্চালন ব্যাখ্যা
করেন, যেখানে হার্ভি পুরো রক্ত সঞ্চালনই ব্যাখ্যা করেন।[vii]
অবশ্য হার্ভিও
কিছু জিনিস বুঝেন নাই, যার জন্য অ্যান্টোয়ান ল্যাভোয়াসিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।[viii]
ইবন আল-নাফিস তার
জারহু তাশবীহিল-কানূন লি ইবন সিনা বইয়ে
রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি বর্ণনা করেন। গ্যালেনের মতে, ডান দিকের প্রকোষ্ঠে, মানে এখন যেটাকে
নিলয় বা ventricle বলি, সেখানে রক্ত
পরিশোধিত হয়ে বাম দিকের প্রকোষ্ঠে যাওয়া দরকার। তিনি বলেন, এটা
অদৃশ্য পথের মাধ্যমে হয়। কিন্তু ইবন আল-নাফিস বলেন, এ দুটার
মাঝে আদান-প্রদানের কোনো পথ নেই।[ix] ব্যাপারটা
ভিন্নভাবে দেখিয়েছেন ইবনুন নাফিস। ফুসফুসীয় ধমনী দিয়ে রক্ত হৃদপিণ্ডের ডান ভেন্ট্রিকল থেকে ফুসফুসে যায়। তারপর
পরিশোধিত হয়ে পালমোনারি শিরার মাধ্যমে পুনরায় হৃদপিণ্ডের বাম ভেন্ট্রিকলে পৌঁছায়। বর্তমান ব্যাখ্যা আরও জটিল বটে, তবে মূল কাজ এটাই।[x]
এখন, প্রশ্ন হচ্ছে ইবন আল-নাফিসের কাজ ইউরোপে
কতটুকু প্রভাব ফেলেছে। ইবন আল-নাফিসের কোন ল্যাটিন নাম নেই। তার কাজসমূহ ল্যাটিনে
অনুবাদ হয় নি। তবে তার রক্ত সঞ্চালন অংশটা আন্দ্রেয়া আল্পাগো অনুবাদ করেছিলেন।
পূর্ববর্তী পর্বে তার সাথে আমরা পরিচিত হয়েছি, যিনি অ্যারাবিক জ্ঞান অর্জনের জন্য
৩০ বছর সিরিয়ায় কাটান। অদ্ভুতভাবে, তিনি বইটি ইউরোপে নিয়ে আসার পর
থেকেই বিভিন্ন ইউরোপিয়ান বিজ্ঞানী পালমোনারি সারকুলেশন এর বর্ণনা দিতে থাকেন।![xi]
খুব স্বাভাবিকভাবেই এতোটুকু পড়ে একজন “বুদ্ধিবৃত্তিক চৌর্যবৃত্তি”
বলে লাফিয়ে উঠতে পারেন এবং ধরে নিতে পারেন যে এ পর্ব সমাপ্ত। কিন্তু আগের পর্ব যদি
মনোযোগ দিয়ে পড়ে থাকেন তো মনে থাকবে যে ট্র্যান্সমিশন রুট ছাড়া বিজ্ঞানের ইতিহাসে কাজ
চলে না। তো চলুন, আবার কিছু মগজ ধোলাই হয়ে যাক।
ফুসফুসীয় রক্ত সংবহন বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন- আন্দ্রেয়াস ভেসালিয়াস, মাইকেল সারভেটাস, মারসেলো মাল্পিজি,
রিয়েল্ডো কলম্বো, হুয়ান ভাল্ভারদে, আন্দ্রেয়া চেসাল্পিনো ইত্যাদি। এদের মধ্যে ভেসালিয়াস আর সারভেটাস অ্যারাবিকে ফ্লুয়েন্ট ছিলেন।[xii].
আল্পাগো পাদুয়া ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন, তিনি ভেনিসে
ইবন আল-নাফিসের কাজ প্রিন্ট পর্যন্ত করিয়েছিলেন। সেখানে স্পষ্টত ফুসফুসীয় সূক্ষ্ম
সঞ্চালনের অংশ অনূদিত ছিল।[xiii]
সর্বপ্রথম রক্ত সঞ্চালন নিয়ে লেখেন মাইকেল সারভেটাস, আর তিনি যে ইবন আল-নাফিসের
থেকে নিয়েছিল, এটাতে কোনোরূপ সন্দেহ নেই।[xiv] তার লেখা অংশ ইবন আল-নাফিসের
সাথে হুবুহু মিলে।[xv]
জার্মান অ্যারাবিস্ট ও বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক ম্যানফ্রেড আলম্যান বলেছেন যে, সারভেটাস
এর ব্যাখ্যা ইবন আল-নাফিসেরটার সাথে এত বেশি মিলে যে সরাসরি প্রভাব কে ডিনাই করাটা
অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাড়ায়।[xvi] ইসলামী
বিজ্ঞানের ইতিহাসের অথোরিটি, অ্যাল্ডো মিয়েলি বলেন যে, সারভেটাস এর কাজ যেন ইবন
আল-নাফিসের ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড অনুকরন![xvii] এর
অর্থ হল, আল্পাগোর অনুবাদ পড়েই ইউরোপিয়ান বিজ্ঞানীরা আসলে রক্ত সংবহন ব্যাখ্যা
করছিলেন। আন্দ্রেয়াস ভেসালিয়াসও পাদুয়া ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন। উইলিয়াম হার্ভি ১৫৯৭ এ পাদুয়ায় যান।[xviii] হার্ভি তার ডক্টরেট
করেছিলেন পাদুয়া ইউনিভার্সিটি থেকে![xix] তার উপর, উইলিয়াম হার্ভির বর্ণনা ইবন আল-নাফিসের বর্ণনার সাথে মিলে।[xx] তাছাড়াও
সেই সময়ে পাদুয়া ইউনিভার্সিটিতে অসংখ্য অটোমান মুসলিম পড়ত।[xxi] যেমন,
নূহ্ ইফেন্দী, যিনি অটোমান সুলতানদের জন্য ১২ বছর ধরে চিফ ফিজিশিয়ান ছিলেন,
পাদুয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছিলেন। আর কিছু লেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়
না।
যা হওয়ারই ছিল, একজন ইউরপিয়ান সায়েন্টিস্টও ইবন আল-নাফিসের
নাম নেননি। হার্ভি
অবশ্য সারভেটাসকেও দাম দেন নাই, শুধু রিয়েল্ডো কলম্বোর নাম নিয়েছিলেন। সারভেটাস কে
খৃষ্টানরা পুড়িয়ে মেরেছিল কিনা, নাম নেওয়া রিস্কি ছিল।[xxii]
যদিও অত্যন্ত ভালো মানের রেফারেন্স আছে যে ইবন আল-নাফিস থেকে তারা নিয়েছিল, তারা ইবন
আল-নাফিসের নাম নিল না।[xxiii]
ধমনির
কাজ, অক্সিজেন বহন করা, তবে ব্যাতিক্রম পালমোনারি
ধমনিঃ সেটি কার্বন ডাই অক্সাইড বহন করে। শিরার কাজ কার্বন ডাই অক্সাইড বহন করা, তবে
এখানে আবারও ব্যাতিক্রম পালমোনারি শিরা,
যা অক্সিজেন হৃদপিণ্ডের বাম অ্যাট্রিয়ামে নিয়ে যায়। ইবন আল-নাফিসও ব্যাতিক্রম; যা গ্যালেন,
ইবন সিনা, হার্ভি একক ভাবে করতে পারেননি, তা ইবন আল-নাফিস করে দেখিয়েছেন।
Notes
and References:
[i] আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, ইলমের ভালবাসায় চিরকুমার উলামায়ে কেরাম (অনুবাদঃ
আবু সাঈদ মুহাম্মদ নু’মান, মাকতাবাতুল আযহার, ২য় প্রকাশ ২০১৯) পৃষ্ঠাঃ ১৭৭ – ১৮৩।
[ii] কুম্ভিলক কোপার্নিকাসঃ https://bit.ly/36Mn6QY
[iii] Haddad,
Sami; Amin A. Khairallah (1936). "A Forgotten Chapter in the History of the
Circulation of Blood". Annals of Surgery. 104 (1): 1–8.
Available at: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1390327
[iv]Michael Hamilton Morgan, Lost History : The Enduring Legacy of Muslim
Scientists, Thinkers and Artists (Washington
D.C. : National Geographic, 2008) p: 214
[v]
Pickthall, Marmaduke
William; Asad, Muhammad. Islamic
Culture. (Islamic Culture Board. 1971)
[vi] John B. West. “Ibn al-Nafis, the Pulmonary Circulation, and The
Islamic Golden Age” muslimheritage.com.
[vii] Michael H.
Morgan, Lost History op. cit.
p: 215
[viii]
Jim al-Khalili, Pathfinders (Allen
Lane, 2010)
[ix] “ইবন আল-নাফিস” in আ. ফ. ম. আব্দুল হক ফরিদী (সম্পা.), ইসলামী বিশ্বকোষ. (২য় সংস্করণ, খন্ডঃ ৪, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০৪)
[x] মাজেদা বেগম et al, জীববিজ্ঞান ২য় পত্র (কাজল ব্রাদার্স লিমিটেড,
২০১৯)পৃষ্ঠাঃ ১৮০-১৮১
[xi] Rabie
el-Said Abdel-Halim. “Contributions of Ibn al-Nafis to the Progress of Medicine
and Urology” muslimheritage.com.
[xii]
Ibid
[xiii]
Ibid
[xiv] J. Schacht,
Ibn al-Nafis, Servetus and Colombo p: 317 – 336, as cited in M. Shamsher
Ali (edt), Muslim Contribution to Science and Technology (Islamic Foundation Bangladesh, 2012)
[xv] Iskander AZ. "The Comprehensive
book on the art of medicine by Ibn al-Nafis". The second International Islamic Medicine
Conference (Kuwait, 1982).
[xvi] Ullman M, Islamic
Medicine. Islamic Surveys, Vol. 11, Edinburgh (IR): Edinburgh
University Press, 1978, pp. 68-69.
[xvii]
S.E. al-Djazairi, The Hidden Debt to
Islamic Civilization (MSBN Books, 2018)
[xviii]
Ghalioungui, P. "Was
Ibn al-Nafis unknown to the scholars of the European Renaissance?" (Clio medica, 1983) p. 38
[xix] Nagamia HF. "A biographical sketch of
the discoverer of the pulmonary and coronary circulation". JISHIM, 2003, 1: 22-28.
[xx] Rabie
el-Said Abdel-Halim. “Contributions of Ibn al-Nafis to the Progress of Medicine
and Urology” muslimheritage.com.
[xxi] Ekmeleddin Ihsanoglu.
“The History of Scientific Interaction” muslimheritage.com.
[xxii]
“ইবন আল-নাফিস” in আ. ফ. ম. আব্দুল হক ফরিদী (সম্পা.), ইসলামী বিশ্বকোষ. (২য় সংস্করণ, খন্ডঃ ৪, ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০৪)
[xxiii]
Mohammed T. Numan. “Ibn Al
Nafis: His Seminal Contributions to Cardiology” Pediatr Cardiol (2014) 35:1088–1090.
0 Comments